মৃনাল হক

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাস্কর শিল্পী ‘মৃনাল হক’ রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর পৈত্রিকনিবাস/আদিভিটা ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের চর-বাসুদেবপুর গ্রামে। চর-বাসুদেবপুর গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববতী সময়ে তৎকালীন নবাবগঞ্জ মহকুমার খামার ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৭০ এর দশকে খামার ইউনিয়ন ভেঙ্গে কিছু অংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়, কিছু অংশ চরঅনুপনগর ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে চর-বাসুদেবপুর গ্রামটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরঅনুপনগর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ৬০ এর দশকের কোন সময় চর-বাসুদেবপুর গ্রাম থেকে রাজশাহী শহরে স্থায়ী হোন মৃনাল হকের পিতা অধ্যাপক একরামুল হক। একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও ভাষাসৈনিক ‘প্রফেসর একরামুল হক’ ছিলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, ১৯৫৫-৫৬ মেয়াদের ভিপি।

১৯৫৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী শহরে মৃনাল হকের জন্ম। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগে ভর্তি হন। পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন ভাস্কর্য বানানোর কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে কাজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। ছাত্রাবস্থায় জাতীয় জাদুঘরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাঙ্গর মাছ এবং তিমি মাছের ভাস্কর্য নির্মাণ করে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়াও সেই সময় তিনি মোজাইক পেইন্টিং কাজ শুরু করেন।

বাংলাদেশে মোজাইক পেইন্টিংক বা ম্যুরাল শিল্পকর্মকে তিনি অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। মূলত তাঁর হাত ধরেই ম্যুরাল শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন, দেশীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার প্রভৃতির উপর অসংখ্য ম্যুরাল, ট্যারাকোটা শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর অসংখ্য শিল্পকর্ম।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপর প্রায় ৩০০ ফিট দৈর্ঘ্য এবং ১০ফিট উচ্চতার মোজাইক পেইন্টিং বা ম্যুরাল শিল্পকর্ম, তৎকালীন ঢাকা জিয়া আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের ভি.ভিআইপি টারমিনালের বাংলাদেশ ও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি কালচারের উপর দৃষ্টিনন্দন প্রায় ৪৫০ফিট দৈর্ঘ্য ও ১০ফিট উচ্চতার ম্যুরাল শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন।

তিনি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের ‘বলাকা’ ভাস্কর্যটি ১৯৮৮ সালের দিকে নির্মাণ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং সেখানে কাজ শুরু করেন। নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী হয়। এছাড়াও নিউইয়র্ক সিটির বিউটি ফিকেশনের জন্য মিনিষ্ট্রি অব কালচার কর্তৃক একমাত্র বিদেশী শিল্পী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তাঁর ম্যুরাল শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। সেই সময় তাঁর ম্যুরাল শিল্পকর্ম এতবেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে, নিউইয়র্কের সরকারি টিভি চ্যানেলে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ২৬ বার এবং সিএনএন চ্যানেলে ১৮ বার প্রচারিত হয়।

২০০২ সালে মৃনাল হক দেশে ফিরে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, ম্যুরাল শিল্পকর্ম, ট্যারাকোটা ও ঝর্ণা ইত্যাদি নির্মাণ করেন। ২০০৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মাণ করেন ‘গোল্ডেন জুবলী টাওয়ার’। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সামনে ‘রত্নদ্বীপ ভাস্কর্য ও ঝর্ণা’, শাহাবাগে অবস্থিত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে ‘রাজসিক’, পরীবাগ মোড়ে “জননী ও গর্বিত বর্ণমালা”, মিন্টু রোডের ডিবি অফিসের পাশে “কোতোয়াল”, প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও কাঁকরাইল চার্চের সামনে নির্মিত “সাম্যবাদ”, সাতরাস্তায় ময়ূরের ভাস্কর্য “বর্ষারাণী” যা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এয়ারপোর্টের গোল চত্বরে মডার্ণ ভাস্কর্য, নৌ সদর দপ্তরের সামনে মাছের ভাস্কর্য ও ঝর্ণা “অতলান্তিকে বসতি”, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পুলিশের ভাস্কর্য, সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে ভাস্কর্য “অর্ঘ”, বঙ্গবাজার সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের পাশে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য “প্রত্যাশা”, আর্মি গলফ্ ক্লাবে নির্মিত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ট্যারাকোটা অন্যতম। এছাড়া তিনি প্রায় ২৫০টির উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন- এলজিইডি কার্যালয়ে, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ করেন।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে শাহজালাল এয়ারপোর্টের সামনের বাউন্ডারি ওয়ালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপর প্রায় ৩০০ফিট দৈর্ঘ্য এবং ১০ফিট উচ্চতার ম্যুরাল শিল্পকর্ম এবং রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় অবস্থিত ভূ-উপগ্রহকেন্দ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭১ফিট উচ্চতা সম্পন্ন ফুল সাইজ মোজাইক পেইন্টিং নির্মাণ করেন।

ভাস্কর্য শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ১২তম এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে ‘এশিয়ান এ্যাওয়ার্ড ২০০৬’ (আন্তর্জাতিক পর্যায়ের), ভারত থেকে অল-ইন্ডিয়া মহাত্মাগান্ধী পুরস্কার ২০২০, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘ঢাকা সিটি বিউটিফিকেশন এ্যাওয়ার্ড (২০০৬) সহ জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। গুণি এই ভাস্কর শিল্পী ২০২০ সালের ২২ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত……/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী-১ম ও ২য় খণ্ড), লেখক- মাহবুবুল ইসলাম ইমন}