অভয়পদ মুখোপাধ্যায়

মানবতাবাদী, সমাজসেবী, আলোকিত মানুষ ‘অভয়পদ মুখোপাধ্যায়’ জন্মেছিলেন ১৯২২ সালের ৫ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বটতলাহাটের জয়নগর মহল্লায়। তাঁর পিতা হরিপদ মুখোপাধ্যায় ও মাতা হেমশশী মুখোপাধ্যায়। তৎকালীন মালদহ জেলার (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) কালিয়াচক থানার সালবাথানীতে তাঁদের র্প্বূ পুরুষদের বসবাস ছিল দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় অভয়পদ মুখার্জী।  চাঁপাইনবাবগঞ্জের পোল্লাডাঙ্গা এম.ই স্কুল এবং হরিমোহন ইনস্টিটিউটে লেখাপড়া করেন তিনি৷ শিক্ষাজীবনে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।  নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় (টাউন হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা-পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৩৯ সাল থেকে সেই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন তিনি শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করে যে অর্থ পেতেন তা গরীব-মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের দান করতেন। সর্বদা তিনি নগ্নপায়ে চলাফেরা করতেন। সাধারণ রিকশাওয়ালা, মুটে-মজুর থেকে সমাজের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁকে ‘অভয় স্যার’, ‘অভয় বাবু’ নামেই জানতেন। ১৯৮২ সালে স্কুলের চাকরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন৷ তবে গৃহশিক্ষতা বজায় রাখেন৷ আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ‘অভয় স্যারের’ অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্র আজ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন৷
শ্রী অভয়পদ মুখোপাধ্যায়ের মানবতাবাদী-সমাজসেবামূলক কর্মকান্ড আবর্তিত হয়েছে মূলত ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশন এবং দাতব্য চিকিৎসালয়কে’ ঘিরে৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ১৯৩২ সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়৷অভয়পদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪০ সালে এ মিশনের সাথে জড়িত হন এবং কালক্রমে এর প্রাণপুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হন৷মৃত্যু অবধি তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক এবং চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ মিশনে বিনামূল্যে রোগীদের হোমিও চিকিসা সেবা প্রদান করা হয়৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জ নবাবগঞ্জ পৌরসভায় এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যার কোনো না কোনো সদস্য অন্তত একবার এখানকার হোমিওপ্যাথির ‘ডোজ’ মুখে নেননি৷ এ কাজে তাঁকে সহকারী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে সহায়তা করেছেন মতিউর রহমান, হরিপদ ঘোষ, মন্টু ঘোষ, খোকন ও বাচ্চু৷ তাঁর মৃত্যুর পর ডা.খোকন চিকিৎসা সেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন৷ সীমাহীন ধৈর্য্য এবং অপরিসীম মমত্ববোধ নিয়ে তিনি প্রতিটি রোগীর সেবা করতেন৷ তাঁর অতুলনীয় সেবা, শ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে তাঁকেই মহত্তর করে তুলেছিল৷ সাধারণ মানুষের কাছে তাই এ প্রতিষ্ঠান ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশন’ হিসেবে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত ‘অভয়বাবুর মিশন’ হিসেবে৷
শ্রী অভয়পদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অকৃতদার৷ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সারাজীবন৷ পার্থিব জগত-সংসারের পিছুটানে জড়াতে চাননি৷ তাছাড়া নারী জাতিকে তিনি মা হিসেবেই দেখতেন৷ ঈশ্বর প্রেমেই তিনি ছিলেন নিবেদিত৷ এসব কারণে বিয়ে করেননি৷ আত্মীয়-স্বজনও তেমন কেউ ছিল না৷ কেবল তিন মামা ছিলেন৷ একমাত্র ছোট ভাই ১৯৭১ সালে মারা যান৷ দুই বিধবা বোন ভারতে বসবাস করেন৷ অভয়পদ মুখার্জ্জী মূলত ছিলেন নিরামিষভোজী৷ মাঝে মধ্যে মাছ খেতেন৷ তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল বিভিন্ন পদের মিষ্টি৷ তিনি ২৪ ঘন্টায় মাত্র একবার-রাতে আহার গ্রহণ করতেন৷ তাঁর প্রিয় পোশাক ছিল সাধারণ ধুতি ও পাঞ্জাবি৷ প্রিয় রঙ ছিল সাদা৷ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সার্বজনীন বিশ্বমানবতায় গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি৷ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, মা সারদা দেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ৷ মানবতাবাদী, সমাজসেবী, আলোকিত মানুষ ‘অভয়পদ মুখোপাধ্যায়’ ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। গুণি এই সমাজসেবককে জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখা থেকে ১৯৯৯ সাালে জাতীয় সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার-সম্মাননা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা থেকে ২০০৩ সালে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা শতবর্ষ পূর্তি উৎসব সম্মাননা’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।