মীরাতুন নেসা

বিশিষ্ট শিশু ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিক্ষক, নারী জাগরণের অগ্রদূত, আলোকিত সংগ্রামী নারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারী মুক্তিযোদ্ধা- ‘মীরাতুন নেসা’ ১৯৫২ সালের ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার জামবাড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাছী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

অতি সাধারণ এবং সংগ্রামী জীবনযাপনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে ‘মহিয়সী-সংগ্রামী নারী’ হিসেবে তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতা শাহ্ মোহাম্মদ কাদের বক্স মিঞা ছিলেন তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট অঞ্চলের সমাজসেবী-জমিদার, সংস্কৃতিনুরাগী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাতার নাম বাসিরুন নেসা। ১৯৮২ সালে মীরাতুন নেসা বিয়ে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, রাজনীতিক-সমাজসেবী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ‘ইসরাইল সেন্টুকে’। ছয় ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মীরাতুন নেসা ছিলেন পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান।

রহনুপর এ.বি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৭০ সালে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। মেধাবী ছাত্রী মীরাতুন নেসা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। স্কুল জীবন থেকেই বাংলাদেশ গার্ল গাইডস, বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। রাজশাহী সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণে অনার্স সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজ থেকে তিনি বি.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন।

বহুমুখী কর্মময় জীবনে ‘মীরাতুন নেসা’ ১৯৭৬ সালে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে রহনপুর রাবেয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (১৯৭৬-১৯৮০) কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর নিজ গ্রাম ভোলাহাটের বড়গাছী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮০-৮২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শঙ্করবাটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (১৯৮৩-১৯৯১) বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে সুনাম এবং সাফল্যের সাথে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে জাতীয় মহিলা সংস্থা, গোমস্তাপুর থানা শাখার সভানেত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। নারী জাগরণ এবং নারীদের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ‘মীরাতুন নেসা’ পরবর্তীতে জাতীয় মহিলা সংস্থা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। গণশিক্ষা কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তিনি সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। নারীদের কল্যাণ এবং সমাজসেবায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৭৮ সালে ‘রহনপুর অন্ধ কল্যাণ শিবির‘ কর্তৃক ‘সেরা সংগঠক ও স্বেচ্ছাসেবী সম্মাননা-পদক’ লাভ করেন। বাংলাদেশ গার্ল গাইড এ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন রাজশাহী অঞ্চলের অন্যতম ‘গাইড/গাইডারস’ হিসেবে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন গাইডার এবং গাইড গাইডারের উপর ‘বিশেষ প্রশিক্ষণ’ প্রাপ্ত হন।

শিশু-কিশোরদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে, স্বামী ‘ইসরাইল সেন্টুর’ অনুপ্রেরণায় ১৯৯৫ সালে ‘মনীষা কিন্ডার গার্ডেন’ নামে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বপ্রথম শিশুদের ‘কিন্ডার গার্ডেন/কে.জি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘মনীষা কিন্ডার গার্ডেনের’ প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, মনীষা কিন্ডার গার্ডেনের পথ অনুসরণ করে পরবর্তীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা স্বুল, হলি চাইল্ড কিন্ডার গার্ডেন প্রভৃতি কে.জি স্কুলসমূহ গড়ে উঠতে শুরু করে।

শুধু শিক্ষক এবং নারী নেত্রী নয়, একজন বায়োকেমিক চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। নাটোর হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে ডি.এইচ.এম.এস কোর্স পড়াশুনা শেষে ১৯৯৭ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বপ্রথম ‘বায়োকেমিক চিকিৎসালয়’ গড়ে তোলেন। স্বামী ইসরাইল সেন্টুর সাথে যৌথভাবে ‘টিসু-রিমেডিজ’ নামের একটি ডিসপেন্সারী-চিকিৎসালয়ে, স্বল্পমূল্যে জটিল রোগসহ গরীব-অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে তিনি চিকিৎসা প্রদান করতেন। পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার মাহতাব উদ্দিন প্রকাশিত এবং সম্পাদিত, চাঁপাইনবাবগঞ্জের একসময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘গৌড় সংবাদ’ এর ‘বিজ্ঞাপন সার্কুলেশন ম্যানেজার’ হিসেবে ২০০০ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, গৌড় সংবাদের প্রতিষ্ঠাতা-নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মীরাতুন নেসার স্বামী জনাব ইসরাইল সেন্টু।

শিশু-কিশোরদের অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে, ১৯৯৮ সালের পর থেকে মৃত্যুঅবধি তিনি জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘরের’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখা, ‘আমপাতা খেলাঘর আসরের’ সাধারণ সম্পাদক/সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শিশু-কিশোরদের শারিরীক ও মানসিক দিক দিয়ে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য ‘শিশু সংগঠক’ হিসেবে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন মীরাতুন নেসা। তাঁরই নেতৃত্বে জেলা শিশু একাডেমি থেকে বেশ কয়েকবার ‘শ্রেষ্ঠ শিশু সংগঠন’ হিসেবে ‘আমপাতা খেলাঘর আসর’ পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও, তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিশু একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সংসদের সহ-সভানেত্রী প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ‘মাহবুবুল ইসলাম ইমন’ দীর্ঘদিন ধরে (বিগত ২৫ বছর) চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ড, গবেষণা, বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন, রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় ভূমিকা রেখে চলেছেন। বর্তমানে নতুন ধারার গবেষণাধর্মী-সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফাউন্ডেশনের’ প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ এর উদ্যোক্তা ও লেখক তিনি। মীরাতুন নেসা ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত/বিস্তরিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ১ম ও ২য় খণ্ড) লেখক- মাহবুবুল ইসলাম ইমন}