বাংলাদেশের প্রথিতযশা গম্ভীরা শিল্পী ও অভিনেতা, কিংবদন্তি কুতুবুল আলম ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাঠানপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশিষ্ট নাট্য অভিনেতা-সংগঠক ও রাজনীতিক এহসান আলী খানের সংস্পর্শে এসে নাটকের প্রতি কুতুবুল আলম আগ্রহী হয়ে উঠেন। বাংলাদেশের প্রথিতযশা অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, হাসান ইমাম, গীতা দত্ত, আনোয়ারা, সুজাতা, নাজনীন, রাণী সরকারসহ বিভিন্ন দেশবরেণ্য নাট্য শিল্পীদের সাথে তিনি নাটক করেছেন। কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেতা- সত্য বন্দোপাধ্যায়ের সাথেও তিনি একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ‘জাত শিল্পী’-কুতুবুল আলম বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক-খাঁ আতার ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজউদ্দোলা’, প্রখ্যাত অভিনেতা রহমান প্রযোজিত ‘দর্শন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। ঐতিহাসিক ‘নবাব সিরাজউদ্দোলা’ চলচ্চিত্রের উর্মি চাঁদ এবং বিখ্যাত ‘দর্শন’ সিনেমার রহমান সাহেবের সেক্রেটারীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে কুতুবুল আলম সেই সময় (ষাটের দশকে) ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন। পেশাগত জীবনে চাকুরি করছেন সচিবালয়ে, ত্রাণ ও পূণর্বাসন মন্ত্রণালয়ে এবং কৃষি অধিদপ্তরে, কৃষি উন্নয়নে অনবদ্য ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ‘রৌপ্য পদক’ অর্জন করেন।
১৯৭২ সালে নাটোর গণভবনে কুতুবুল আলম ও রাকিব উদ্দিন (নানা ও নাতী) প্রথম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে গঠনমূলক-সমালোচনামূলক গানের মাধ্যমে গম্ভীরা পরিবেশন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্য, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কয়েক শত উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বড় নানা’ সম্বোধন করে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নানা সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার বিষয়-চিত্রগুলো গম্ভীরা গানের মাধ্যমে শত শত মানুষের মাঝে তুলে ধরেন নানা-কুতুবুল আলম এবং নাতী-রাকিবউদ্দিন। তাঁদের এই সমস্যা ও অভাব-অভিযোগ, দু:খ-কষ্টের কথা শুনে কখনও কেঁদে ফেলেন, আবার কখনও তাঁদের ব্যাঙ্গরসাত্বক কথা শুনে হেসেও ফেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দিন উচ্ছ্বাসে নানা-কুতুবুল আলমকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুই কে ? এতো কথা বললি, আমি শুনলাম এবং চেষ্টা করবো সব সমস্যার সমাধান করার…’ সেই দিন দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে নানা কুতুবুল আলম বঙ্গবন্ধুর হাতে একটি লাঠি আর মাথায় মাথল পড়িয়ে দিয়ে বলেন, তোমার লোকেরা ভুল করলে লাঠি দিয়ে পেটাবা আর রোদ বৃষ্টিতে গেলে এই মাথল তোমাকে বাঁচাবে বড় নানা’। সেই দিন থেকেই মূলত কুতুবুল আলম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বড় নানা বলে ডাকতেন। কুতুবুল আলম (নানা) ও রাকিব উদ্দিনের (নাতী) গম্ভীরা গানের মাধ্যমে চিহ্নিত দেশের অন্যতম ৬টি সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ডকুমেন্টরী ফিল্ম তৈরি করে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শাসনামলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্যবাহী ‘গম্ভীরা’ গানকে জনপ্রিয়তার চরম শিখরে পৌঁছে দিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে কুতুবুল আলম ও রাকিব উদ্দিনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গম্ভীরা গান একসময় এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও এই গম্ভীরা গানকে খালকাটা কর্মসূচি, স্বনির্ভর বাংলাদেশ এবং কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করেন। এয়াড়া, তাঁর শাসনামলে বৃক্ষরোপন, পরিবার পরিকল্পনা, মৎস চাষ জোরদার করার জন্য গম্ভীরা গানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও কুতুবুল আলম-রাকিব উদ্দিন এবং তাঁদের গম্ভীরা গানকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা কুতুবুল আলমকে চাচা বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৯৮ সালে কুতুবুল আলম মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এবং পরবর্তীতে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হলে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করেন। এ সময় চিকিৎসার জন্য তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী ওবাইদুল কাদেরসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর গম্ভীরা গানের প্রবাদপুরুষ, কিংবদন্তি কুতুবুল আলম মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত…/বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষপ্তি জীবনী)}