‘রমেন্দ্রনাথ মিত্র ওরফে রমেন মিত্র (হাবু বাবু)’ একজন প্রগতিশীল রাজনীতিক-সমাজসেবী, ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নেতা। কমরেড ‘রমেন মিত্ ‘ ১৯১৩ সালে তৎকালীন মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরহাট এলাকার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহেন্দ্রনাথ মিত্র (দেওয়ান) এবং মাতা বিশ্বমায়া মিত্র। ব্রিটিশ বাংলায় তাঁর বাবার দেওয়ানী ছিল এবং তাঁর মাতা ছিলেন রাজশাহীর সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের মেয়ে। রমেন মিত্রের তিন ভাই ও তিন বোন। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার আদরের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। রমেন্দ্রনাথ মিত্রকে এলাকাবাসীসহ সকলে ‘হাবু বাবু’ নামেই ডাকতো। রমেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন মূলত প্রচারবিমুখ এক প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক মানুষ।
হাবু বাবু ওরফে রমেন মিত্র ওরফে রমেন্দ্রনাথ মিত্র তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলকাতার এক কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তিনি তাঁর এলাকার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাই স্কুলে বিনা সম্মানীতে শিক্ষকতা করতেন এবং বাবার জমিদারী দেখাশুনা করতেন। ১৯৪৭ সালে প্রগতিশীল নারী ইলা মিত্রকে বিয়ে করেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁরা দু’জনেই ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য, অন্যতম কমরেড। বামপন্থী দর্শনে বিশ্বাসী রমেন মিত্র ও ইলা মিত্রের রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন দর্শনে মিল থাকায় তাঁরা একে অপরের সহযোগী-সহযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেন। ঐতিহাসিক তেভাগা-কৃষক আন্দোলনের নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের পরামর্শক এবং উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন তাঁর স্বামী-সহযোদ্ধা রমেন্দ্রনাথ মিত্র। বাল্যজীবনে ইলা মিত্র খেলাধুলায় ভালো ছিলেন, কলকাতায় অনুষ্ঠিত ক্রীড়ানুষ্ঠানে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। প্রখ্যাত রাজনীতিক ইলা মিত্র এক সময় পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য হয়েছিলেন।
১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে রমেন-ইলা মিত্ররা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কলকাতায় চলে যান। তাঁদের এক কালের জমিদারী বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। তাঁরা সবকিছুই ত্যাগ করে গেছেন। জমিদার বংশের মেয়ে হলেও ইলা মিত্র চলাফেরা করতেন সাধারণভাবে। জমিদার কর্র্র্র্তৃক লাঞ্চিত, বঞ্চিত, অবহেলিত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক জনতাকে তাঁদের নায্য অধিকার পাইয়ে দেয়াই ছিল ইলা-রমেন মিত্রের রাজনৈতিক সংগ্রাম, জীবনের মূলত লক্ষ্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জ তথা পূর্ব বাংলা ছেড়ে যাবার প্রায় ৪২ বছর পর ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন রমেন-ইলা মিত্র। তে-ভাগা আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ইলা মিত্রকে ১৯৯৬ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় প্রাণঢালা সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ঐ মাসের ৬ তারিখ সকালে রাজশাহীর ভূবন মোহন পার্কে এবং দুপুর ২টার দিকে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থান নাচোল কলেজ মাঠে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সেখানে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। তাঁদেও ‘রাণী মার আগমনে নাচোল অঞ্চলের অধিবাসীরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
এর কয়েক বছর পরেই ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর প্রায় ৭৭ বছর বয়সে নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী, তেভাগা আন্দোলেনর কিংবদন্তি কমরেড ইলা মিত্র কলকাতার একটি ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে ২০০৫ সালে ৯২ বছর বয়সে ইলা মিত্রের স্বামী, তেভাগা আন্দোলেনের পুরোধা রমেন্দ্রনাথ ওরফে রমেন মিত্র (হাবু বাবু) মারা যান। বর্তমানে ইলা-রমেন মিত্রের একমাত্র সন্তান রণেন মিত্র মোহন কলকাতার এক কোম্পানীতে চাকরি এবং তাঁর স্ত্রী কলকাতার একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। রণেন মিত্র মোহনের সন্তান অর্থাৎ ইলা-রমেন মিত্রের একমাত্র নাতী ঋতেন্দ্রনাথ মিত্র উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য আমেরিকায় বসবাস করছেন। {অসমাপ্ত/বিস্তারিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ১ম ও ২য় খণ্ড) লেখক- মাহবুবুল ইসলাম ইমন}