নারী জাগরণের অগ্রদূত, গুণি শিক্ষক, আলোকিত নারী- ‘মার্জিনা হক (পারুল)’ ১৯৪২ সালের ২৯ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তরিকুল ইসলাম ও মাতা মতিয়া বেগম।
১৯৫৭ সালে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ গার্লস একাডেমি থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন। তখন প্রথম বিভাগে নারী হিসেবে মেট্রিকুলেশন পাসের ঘটনা ছিল বিরল ও গৌরবের বিষয়। পরবর্তীতে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯৬২ সালে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুর হাসিনা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের (গার্লস একাডেমি) প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুনাম ও সাফল্যের সাথে দীর্ঘ ২৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ গার্লস একাডেমি সরকারিকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মেয়েদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন ও দায়িত্বশীল বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে স্কুলে গার্লস গাইড কার্যক্রম চালু করেন।
মানুষ গড়ার কারিগর-আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মার্জিনা হকের সুনাম রয়েছে। দীর্ঘ ৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্রী পড়িয়েছেন, যারা আজ জেলার কৃতি সন্তান, সরকারি-বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
গুণি শিক্ষক শুধু নন, তিনি ছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীদের কল্যাণে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। রাজশাহী অঞ্চলের গার্লস গাইড প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মার্জিনা হক ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হোন। পরবর্তীতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। উপ-পরিচালক থাকাকালীন তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহী জেলার স্কুলসমুহের মানোন্নয়নসহ গার্লস গাইডের উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
উপ-পরিচালকের দায়িত্বের পাশাপাশি গার্লস গাইডের রাজশাহীর আঞ্চলিক কমিশনারের দায়িত্বও পালন করেন। রাজশাহীর আঞ্চলিক গার্লস গাইডের স্থায়ী অফিস প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালে রাজশাহীতে দুই একর জমির উপর গার্লস গাইডের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়।
অবসরের পরেও তাঁকে গার্লস গাইড রাজশাহীর আঞ্চলিক কমিশনার পদে বহাল রাখা হয়। সবশেষ গার্লস গাইডের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিশনার হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে গেছেন বহুদিন। জড়িত ছিলেন জাতীয় মহিলা সংস্থাসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে।
সমাজসেবী ও সংগঠক হিসেবে মার্জিনা হকের পরিচিতি রয়েছে। ১৯৭২ সালে তৎকালীন নবাবগঞ্জ মহুকুমা প্রশাসক এম.এ সিদ্দিক চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ নারীদের নিজ যোগ্যতাবলে আয় উৎসারী কাজের পথ তৈরি করার জন্য ‘কল্যাণী মহিলা সংসদ’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ‘কল্যাণী মহিলা সংসদের’ প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসকের সহধর্মিনী ডলি সিদ্দিক এবং প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সমাজসেবী মার্জিনা হক।
প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি তিলেতিলে বড় করেছেন, নিজস্ব ভবন-স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছেন। আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত নকশী কাঁথা, মেয়েদের ব্যাগ, ড্রেস, পাখাসহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী তৈরী করে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। যার সদস্য সংখ্যা চার শতাধিক। ১৯৮৪ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ‘কল্যাণী মহিলা সংসদ’ ১৯৮৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে এবং ১৯৯০ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরষ্কার লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষাবিদ ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ‘অধ্যাপক এনামুল হক’ ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী। তাঁদের সুযোগ্য সন্তান ডা. সালমা আরজুমান্দ বানু বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ)। আরেক সুযোগ্য সন্তান জাকিউল হক বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি, কানাডা থেকে এমএসসি করে বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত রয়েছেন। মহিয়সী নারী ‘মার্জিনা হক’ ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত……/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী)}