বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন সাবেক ছাত্রনেতা- ‘এসএম হাফিজুল ইসলাম’ ১৯৫০ সালের ১৩ মার্চ গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ ডাকেন শেখ হাফিজ বলে। বাবার রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে তাঁর বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া এবং স্থায়ী বসবাস চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মাধ্যমিকে থাকতেই ছাত্রলীগের প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত হোন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা (পরে জেলা) ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্যও ছিলেন সেই সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ হাফিজুল ইসলাম।
শেখ হাফিজ ১৯৬৬ সালে নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করেন। পরবর্তীতে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৬৯ সালে রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে প্রথম দেখেন জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের বাড়িতে। প্রথম দেখায়ই হাফিজ বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভালবাসা, নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বক্ষণ অবিচল। বঙ্গবন্ধুর যতটুকু সাহচর্য ও সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন সেই অমূল্য সম্পদকে আঁকড়ে আছেন সারাজীবন। এ জন্যই বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা নিজের নামে নয়, অসংখ্যবার পরিবারের একমাত্র কোরবানি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর নামে। কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও স্থায়ীভাবে কোন পেশায় তিনি যুক্ত হননি। অনেকটা সময় পার করেছেন অসুস্থতায়। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাফিজুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে নিখাঁদ ও গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা অন্তরে লালন করেন তা সত্যিই বিরল।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ হাফিজের অনেক স্মৃতি। তাঁর জবানীতেই দুটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথম ঘটনা ১৯৭৪ সালের। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ডা. মেসবাহুল হক বাচ্চু (তৎকালীন সংসদ সদস্য), বজলার রহমান ছানা (বিচারপতি, আপিল বিভাগ) ঢাকায় এসেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। একই সঙ্গে গোপালগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন নুরুল কাদির জুন্নু (তৎকালীন সংসদ সদস্য), ডা. এম আমজাদ হোসেন (সামাদ ডাক্তার, ইউপি চেয়ারম্যান) প্রমুখ। প্রথমে গোপালগঞ্জের টিম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সামাদ ডাক্তারের উদ্দেশে বলেন, ডাক্তার হাফিজকে চিনিস? ওর বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমার বিরাট ছাত্রনেতা।’
তখন সামাদ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বললেন, ও আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ও কাশিয়ানীর ছেলে জানতাম, কিন্তু আমাদের পরিবারের ছেলে তা তো কখনও বলোনি! এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিম সাক্ষাতে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বাধা দিলে, বিষয়টি তোফায়েল আহমেদের নজরে আসে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওকে বাধা দিও না। ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য’। মূলত পারিবারিকভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহভাজন এবং ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাফিজুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎকালীন ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হোন। ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে ৭ নং সেক্টরের অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের মুশরীভোজা, দলদলী প্রভৃতি অঞ্চলের যুদ্ধে তিনি গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট শেখ হাফিজের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ছন্নছাড়া জীবনযাপন করেছেন। তবে বর্তমানে সুস্থ রয়েছেন। বস্তুত পঁচাত্তরের পরে তিনি রাজনীতি থেকে যেমন স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন, তেমনি পেশাগত জীবনেও আর স্থির হতে পারেননি।
১৯৭৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মনিমুল হক সড়কের (আ.লীগ অফিসের সামনে) স্থায়ীবাসিন্দা ‘সেরাজুল হক শনি মিঞা (মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আ.লীগ নেতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার স্বাধীনতা উত্তর প্রথম চেয়ারম্যান) এর কন্যা সেলিনা হাফিজের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক শেখ হাফিজের সুযোগ্য সন্তান শেখ শহিদুল ইসলাম (রুমু) চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম সাবেক ছাত্রনেতা (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক), বর্তমানে কেনিয়াতে কর্মরত রয়েছেন।
শেখ হাফিজের সুযোগ্য স্ত্রী সেলিনা হাফিজ দীর্ঘদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রীণভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সেলিনা হাফিজ সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, গার্লস গাইড প্রভৃতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে পরিবারসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মনিমুল হক সড়কে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন শেখ হাফিজুল ইসলাম। {অসমাপ্ত……/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী-১ম ও ২য় খণ্ড), লেখক- মাহবুবুল ইসলাম ইমন}