বিশিষ্ট ক্বারীউল কোরআন, সমাজসেবী- ক্বারী মুহা. ইসারুল হক ১৯১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. ইসমাইল মোল¬া এবং মাতার নাম সালেহা খাতুন। ১৯৩৩ সালে রাজারামপুর গ্রামের কয়েকজন ইসলাম হিতৈষী ব্যক্তি `খারেজী ইসলামিয়া মাদ্রাসা’ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ক্বারী মো. আনোয়ারুল্লহকে (পূর্ বাংলার ত্রিপুরা জেলার বিশিষ্ট ক্বারীউল কোরআন, প্রখ্যাত আলেম) প্রধান হুজুর এবং ক্বারী মুহা.ইসারুল হক উক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ক্বারী মুহা. ইসারুল হক শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে মাওলানা ক্বারী মো.আনোয়ারুল্লহর কাছে আরবী, উর্দু, ফার্সি শিক্ষালাভ করেন এবং শুদ্ধভাবে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত ও কোরআন শরীফের ব্যাখ্যা প্রদান করার দক্ষতা অর্জন করেন। উর্দুতে লিখিত জামালুল কোরআন ও নুজহাতুল ক্বারী এবং বাংলায় লিখিত ক্বারীউল কোরআন অধ্যায়ন করে সম্যখ জ্ঞান লাভ করেন। একই সাথে আরবী, উর্দু ও ফার্সি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং সর্বোপরি হরকতবিহীন বিখ্যাত আরবী সাহিত্য ‘কালিউবি’ অধ্যায়ন করে দক্ষতা অর্জন করলে বড় হুজুর (মাওলানা ক্বারী মো.আনোয়ারুল্ল¬াহ) তাঁকে কোরআন শরীফ শুদ্ধ উচ্চারণে তেলাওয়াত ও সঠিক ব্যাখ্যাদানে পান্ডিত্য অর্জনকারী ক্বারীউল কোরআন খেতাবে ভুষিত করেন। তখন থেকে নিজ গ্রামের মানুষের কাছে তিনি রবুক্বারী এবং শহর ও অন্যান্য এলাকায় ‘ক্বারী সাহেব’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নিজগ্রামে মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসায় ছেলে মেয়েদের কোরআন শিক্ষা এবং একাধিক স্কুলে শিক্ষকতা করে একজন দক্ষ অংকের শিক্ষক এবং ক্বারীউল কোরআন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন ক্বারী মুহা. ইসারুল হক।
১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে টিকরামপুর প্রাইমারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং সেখানে একটা মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় টিকরামপুর প্রাইমারী স্কুলের অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাযে ইমামতির মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে ফকিরপাড়া জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি একটানা ৫০ বৎসর ইমামতি করে অবসরে যান যা একটি বিরল ঘটনা। তিনি যখন মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ভাঙ্গা ইট দিয়ে কাদার গাথুনিতে ২টি তীরের ২ পাশে বাঁশের খুটি দেয়া একটি জীর্ণ মসজিদ ছিল। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সকলের সহযোগিতায় ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে একটি বৃহৎ বিল্ডিং মসজিদে পরিণত করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১, ১৯৭৮ ও ১৯৮০ সালে বন্যায় মসজিদটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হলে তিনি সকলের সহযোগিতা নিয়ে মসজিদটিকে শহরের অন্যতম বৃহৎ ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত মসজিদে পরিণত করেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা, সততা, কর্মদক্ষতা, পান্ডিত্য ও মধুর ব্যবহারের মাধ্যমে দল-মত নির্বিশেষে শহরের সকল শ্রেণীর-পেশার মানুষের কাছে সর্বজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। ১৯৯৫ সালে ভোটার তালিকা হাল নাগাদ করার কর্মসূচী শুরু হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ভোটার তালিকায় ক্বারী মুহা.ইসারুল হককে প্রথম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জেলার ভোটার তালিকা হাল নাগাদ করার কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন।
ক্বারী মুহা. ইসারুল হক ১৯৬৪ সালে পাঠানপাড়া প্রাইমারী স্কুলে যোগদান করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পৌরসভা থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে একটি সুন্দর বিল্ডিং স্কুল নির্মিত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা থাকাকালীন মহকুমা প্রশাসকগণ এবং পরবর্তীতে জেলায় উন্নতি হলে জেলা প্রশাসকগণ এবং জেলার অনেক কর্মকর্তা শুক্রবার ফকিরপাড়া জামে মসজিদে জুমার নামায আদায় করতেন। তাঁর মধুর কন্ঠে শুদ্ধ উচ্চারণে কেরাত পাঠ সকলকে আকৃষ্ট করত এবং বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর ইমামতিত্বে নামায পড়ার জন্য ফকিরপাড়া জামে মসজিদে আসতেন। ২০০৪ সালে ফকিরপাড়া জামে মসজিদে তাঁর ইমামতির ৫০ বৎসর পূর্ণ হয়। ৮৫ বৎসর বয়সের কারণে এতবড় গুরু দায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয় বলে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। অনিচ্ছা সত্বেও স্থানীয় জনগণ তাঁর এই বিরল দায়িত্ব পালন শেষে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তাঁর বিদায় উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকগণ এবং জেলার অনেক কর্মকর্তা, বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ শহরের সকল শ্রেণীর মানুষ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখা ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ইমাম সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ক্বারী মুহা. ইসারুল হক। ১৯৭৬ সালে নির্মিত ‘নবাবগঞ্জ কোট’ মসজিদের ভিতরে ও বারান্দায় আরবী আয়াত ও আল¬াহ্ তায়ালার ১০০টি নাম বাঁশপাতার কাগজে জোড়া দিয়ে দিয়ে পরিমাপ করে নিজ হাতে লেখেন। কোট মসজিদ ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি মসজিদে কলেমা শরীফ ও আয়াত শরীফ লিখে দিয়েছেন। এজন্য তিনি কোথাও কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। ২০০০ সালে তিনি হজ্বব্রত পালন করেন। ফকিরপাড়া মসজিদের ইমামতির পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন নবাবগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে পবিত্র ঈদের নামাযে ইমামতি করেন। মসজিদ থেকে অবসর নেয়ার পরেও ঈদগাহ কমিটির সকলের অনুরোধে আরো কয়েকবার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামায পড়ান সর্বজন শ্রদ্ধেয়, বিশিষ্ট ক্বারীউল কোরআন ও সমাজসেবী- ক্বারী মুহা. ইসারুল হক। বর্তমানে ৯৬ বৎসর বয়সে তিনি সুস্থ আছেন তবে স্মরণ শক্তি কিছুটা লোপ পেয়েছে। বয়সের কারণে তিনি বাড়ির বাইরে খুব একটা বের না হলেও বাড়ির পাশের মসজিদে নিয়মিত নামায পড়েন।
{ অসমাপ্ত…/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষপ্তি জীবনী) }