ঐতিহ্যবাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসের উপর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘নবাবগঞ্জ পরিচিতি (১৯৬৬) এর লেখক, খ্যাতিমান সাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিক ‘আবুল কালাম শেখ নূর মোহাম্মদ’ ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারী তৎকালীন মালদহ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) জেলার কালিয়াচক থানার গয়েশবাড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ নামেই অধিক পরিচিত। বিয়ে করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি মহল্লার বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল মতিন সাহেবের বোন এম.এ আজিজা মোহাম্মদকে। আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ মালদহ জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজে অধ্যায়ন করেন। ১৯৪৫ সালে কলেজ ছেড়ে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের চাকুরীতে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সাল থেকে ‘নবাবগঞ্জ মহকুমা জনসংযোগ অফিসার’ হিসেবে সুনামের সাথে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
সদা চঞ্চল, কর্মব্যস্ত এই মানুষটি ‘নবাবগঞ্জ মহকুমা জনসংযোগ অফিসার’ থাকাকালীন সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন তিনি। তাঁর সহধর্মিনী এম.এ আজিজা ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংবাদিকতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। তৎকালীন নবাবগঞ্জ মহকুমার সকল সাংবাদিকদের সংগঠিত করে ‘মহকুমা সাংবাদিক সমিতি’ প্রতিষ্ঠা-পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে শিবগঞ্জের প্রখ্যাত চারণ সাংবাদিক মহসীন আহমেদ, নবাবগঞ্জের বিশিষ্ট সাংবাদিক মজিবুর রহমান(তারু মিঞা), সাংবাদিক আব্দুল মতিন, সাংবাদিক শাহজামান, সাংবাদিক মোহিত কুমার দাঁ, আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ এবং তাঁর সহধর্মিনী এম.এ আজিজা প্রমুখদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বপ্রথম সাংবাদিকদের সংগঠন-‘নবাবগঞ্জ মহকুমা সাংবাদিক সমিতি’ গঠিত হয়। যা পরবর্তীতে ‘নবাবগঞ্জ প্রেসক্লাবে’ রুপান্তরিত হয়।
খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও গবেষক- আবুল কালাম শেখ নূর মোহাম্মদ ছিলেন তৎকালীন ‘গৌড় বঙ্গ সাহিত্য-পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। তাঁরই প্রচেষ্টায় মালদহ জেলা থেকে সেই সময়ে মাসিক ‘আজান’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। তিনি সাপ্তাহিক ‘আদিনা’ ও ‘মালদহ আখবার’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে আজান (কবিতা), মঞ্জুরী (কবিতা), বুনো মেঘ কথা কয় (কবিতা), এই স্বাধীনতা (ছোটগল্প), আসছে বছর (উপন্যাস), নারী ও নগরী (গল্পসংগ্রহ), বিপ্রতীব (উপন্যাস) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ৬০ এর দশকে তিনি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-বৃহত্তর রাজশাহী তথা উত্তরবঙ্গের একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক আবুল কালাম শেখ নূর মোহাম্মদ দীর্ঘদিন দিনাজপুরে বসবাস করেছেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতার বিকাশের অগ্রপথিক ‘আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ’ সাহেব সম্ম্রাট ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের’ মতোই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘যে জাতি আত্ম বিস্মৃত, যারা নিজেদেরকে চিনে না, ঐতিহ্য সচেতন নহেন, সে জাতি মৃত…!’ এই বোধ ও জীবন জিঙ্গাসা থেকেই তিনি গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী অনুসন্ধানী-গবেষক, লেখক হিসেবে উত্তরাধিকারী সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র এক মাসের মধ্যে শতাধিক পৃষ্ঠার ‘নবাবগঞ্জ পরিচিতি’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ১৯৬৬ সালে। যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, তৎকালীন নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক- প্রফেসর আবুল হায়াত। প্রায় ৫০ বছর পূর্বে প্রকাশিত তাঁর এই গ্রন্থটি আজ প্রায় দুষ্প্রাাপ্য হয়ে গেছে। হাজার বছরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্য তাঁর এই এই বিখ্যাত, সৃষ্টিশীল গ্রন্থটি ‘আদি-আকর গ্রন্থ’ হিসেবে আজও চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কোন কোন লেখক-গবেষকেরা গ্রন্থ লিখলেও শুধুমাত্র ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং তার ইতিহাস-ঐতিহ্য’ নিয়ে লেখা এটাই প্রথম কোন গবেষণামূলক মৌলিক গ্রন্থ। পরবর্তীতে আ.ক.শ নূর মোহাম্মদের এই ‘আদি-আকর গ্রন্থটিকে’ ভিত্তি হিসেবে ধরেই মূলত ড.মাযহারুল ইসলাম তরু, ড.শহীদ সারওয়ার আলো, প্রফেসর এলতাস উদ্দিন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা (চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধানী গবেষক ও লেখক), তাঁদের লেখনির মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আরও বর্ধিত করে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, একজন তরুণ লেখক হিসেবে আমারও মূল প্রেরণা ও চালিকাশক্তি আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ এবং তাঁর এই ‘আকর গ্রন্থটি’। আমার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শ বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী-আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ বইটি লিখতে গিয়ে রেফারেন্স হিসেবে এই বইটি আমাকে নির্ভরযোগ্য তথ্য (বহু পুরানো ব্যক্তিদের তথ্য) পেতে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। এই বইটি এবং আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ সাহেবের সাথে কাকতালীয়ভাবে আমার প্রকাশনার অদ্ভুত একটি মিল রয়েছে। সেটি হল ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর প্রথম গ্রন্থ ‘নবাবগঞ্জ পরিচিতি’ বইটি লিখেছেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌরবময় ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ এবং অনুসন্ধানী-গবেষক, লেখক হিসেবে উত্তরাধিকারী সৃষ্টির লক্ষ্যেই মূলত তাঁর এই গ্রন্থ রচনা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান জানিয়ে তরুণ লেখক (অনুসন্ধানী-গবেষক) হিসেবে বৃহৎ পরিসরে আমি প্রথম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌরবময় ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের (বিভিন্ন প্রকার পাঁচ শতাধিক) বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী-‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ গ্রন্থটি লিখছি। ইতিমধ্যেই নতুন ধারার সৃষ্টিশীল উদ্যোগ কিংবা বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশনা প্রকল্প (প্রিন্ট,অনলাইন সংস্করণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। পরিশেষে, এই লেখার মাধ্যমে গুণি এই সৃষ্টিশীল ব্যক্তি এবং তাঁর মহৎ সৃষ্টিকর্মকে কৃতজ্ঞচিত্তে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি…।