মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী- প্রফেসর মনিমুল হক জন্মেছিলেন ১৯২২ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের নামোশংকরবাটির মন্ডলপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শহীদ বুদ্ধিজীবী- প্রফেসর মনিমুল হক ১৯৫৫ সালে নবাবগঞ্জ কলেজ (পরবর্তীতে সরকারি) প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং উক্ত কলেজের প্রথম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর মনিমুল হক সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন না। তবে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনকে মনে-প্রাণে সমর্থন করতেন।
১৯৭১ এ চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত ১০-সদস্য বিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য সেরাজুল হক শনি মিয়াদের বাড়িতেই (বর্তমান শহীদ মনিমুল সড়কের জেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সামনে) প্রতিদিন স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হত। শনি মিয়া-মনিমুল হক দু’ভাই একই বাড়িতে বাস করতেন। ছোট ভাইয়ের নিকট হতে প্রফেসর মনিমুল হক উৎসাহের সাথে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বিশেষত:মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতেন। ২১ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর পুণরায় পাকবাহিনীর করায়ত্ব হলে দু’ভাই-এর বাড়িটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারত গমনের দিনই বিকেলে তাঁর ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক মাষ্টারের বাড়ি, চৈতন্যপুরে থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে। সেখান থেকে তাঁকে নবাবগঞ্জ ও নাটোর হয়ে ঢাকায় নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আটক রাখা হয়। সেখানে তাঁর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর অপর ভাই প্রফেসর ড.বজলুল হক মাঝে-মধ্যে তাঁর সাথে সাাতের সুযোগ পেতেন। অক্টোবরের ২০ তারিখে প্রফেসর মনিমুল হককে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭১ এর ১৪ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় পাকবাহিনীরা তাঁকে আবারও বাড়ি থেকে ধরে রাজশাহীতে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে তাঁকে কর্ণেল রিজভীর সামনে হাজির করা হলে কর্ণেল রিজভী তাঁকে অভিযুক্ত করে বলেন, তিনি তাঁর দুই ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে পাঠিয়েছেন, তাঁর মেজো ভাই মুক্তির নেতা, তিনি আওয়ামী লীগ করেন, স্বরস্বতী পূজায় কলেজ ফান্ড থেকে হিন্দুদের চাঁদা দিয়েছেন ইত্যাদি। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি কিছু বলতে চাইলে কর্ণেল রিজভী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে জানান যে, ইতোমধ্যেই তাঁর বোর্ড হয়ে গেছে। তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। এরপর তাঁকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের নীচ তলার একটি কেক্ষ তাঁকে ২ দিন অভূক্ত অবস্থায় রাখা হয়। ২০ নভেম্বর অর্থাৎ ’চাঁদ রাতে (শাওয়াল মাসের প্রথম চাঁদ দেখা রাতে)’ ২ টার সময় পাক ফৌজের ঘাতক দল তাঁর চোখ কালো কাপড়ে এবং হাত দুটো বেঁধে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যায়। যেখান থেকে তিনি আর কোন দিনই ফিরে আসেননি। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনরা শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশে ইটের ভাটা, কাটাখালী ছাড়াও রাজশাহী, নাটোরের সকল বধ্যভূমি, গণকবর এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প খুঁজেও তাঁকে মৃত বা জীবিত উদ্ধার করতে পারেন নি।
সমাজসেবী মনিমুল হক ১৯৭০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১টি নৈশ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চন্ডীমন্ডপ (পরবর্তীতে নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়) স্কুলে নৈশ কলেজের কিছুদিন কাসও হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর উক্ত কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ আর এগোয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাঠাগার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কাব ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর কর্তৃপক্ষ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘শহীদ মনিমুল হকের বাসভবন (বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সামনে) হতে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ পর্যন্ত ৪৫০ মিটার দীর্ঘ সড়কটি’ তাঁর নামানুসারে নামকরণ করেন। শহীদ মনিমুল হকের স্মৃতির রক্ষার্থে, সম্প্রতি নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর সুলতানা রাজিয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলেজ কমপ্লেক্সের এগজামিনেশন ও একাডেমিক ভবনটি ‘শহীদ মনিমুল হকের’ নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। { অসমাপ্ত… / বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষপ্তি জীবনী) }