‘মোহাম্মদ ইজারউদ্দীন পন্ডিত’ একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী। ১৮৯৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামোশোঙ্করবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৪ সালে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। তৎকালীন ‘ছেলেদের ভূগোল শিক্ষা’ নামের পাঠ্যপুস্তকের লেখক-প্রণেতা তিনি। তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুর এম.ই স্কুলের হেড পন্ডিত হিসেবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। তাঁর পিতা ইনাতুল্লা মণ্ডল। তাঁর স্ত্রীর নাম নাইরাতুন নেসা।
ইজারউদ্দীন পন্ডিতের পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিলো মহানন্দা নদীর ওপারে ‘ইসলামপুরে’। সেই সময়কার ব্রিটিশ সরকার জোর পূর্বক নীল চাষ করাতে জনগণকে বাধ্য করতো। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা এই ‘জোর পূর্বক/বাধ্য বাধকতার’ বিরোধিতা করেছিলেন। প্রতিবাদী পুরুষ ‘মোহাম্মদ ইজারউদ্দীন পন্ডিতের’ শরীরে সেই বিরোধিতার রক্ত প্রবাহিত ছিল বলেই হয়তো তিনিও রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্রিটিশদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছিল ব্রিটিশরা যখন তাঁর মালিকানাধীন আমের বাগানে উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ না দিয়ে রেল স্টেশন স্থাপন করার চেষ্টা করে। স্থানটি বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেল স্টেশন। একদিকে ব্রিটিশরা রেল লাইন বসাতো আর অন্যদিকে সেই রেল লাইন উপড়ে ফেলতেন তিনি। এক পর্যায়ে সরকার তাঁকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেলষ্টেশন স্থাপন করে।
তরুণ বয়সে নবাব সিরাজ উদ-দৌল্লা নাটকে অভিনয় করে সাধারণ মানুষকে উজ্জবিত করতেন ইজারউদ্দীন পন্ডিত। তাঁর পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র স্ব-শিক্ষিত। সে সময় পড়াশুনার এতো চল ছিলনা। সেই আমলে রংপুরে পালিয়ে গিয়ে গুরু ট্রেনিং নিয়েছিলেন। এক জেলা থেকে অন্য জেলা যেতে অনেক সময় লাগতো। ট্রেন, বাস বা পাকা রাস্তা কিছুই ছিল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী প্রায় ২৫/৩০ মাইল দূর এবং তা যেতে হতো অনেক কষ্ট করে। রাস্তাও ছিল কাঁচা। আর রংপুর সেতো কল্পনাও করা যায় না। শিক্ষালাভের জন্য সেই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে যাওয়ার সাহস করেছিলেন তিনি। গুরু ট্রেনিং নিয়ে তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুর এম.ই স্কুলের হেড পন্ডিত হিসেবে সুনামের সাথে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। তৎকালীন সময়ে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান রয়েছে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহ দিতেন। মেয়েদেরকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য অভিভাবকদের উৎসাহিত করতেন। এলাকায় গ্রাম্য শালিশে প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কৃতী পুরুষ ‘ইজারউদ্দীন পন্ডিতের’ তিন ছেলে। মোহাম্মদ আব্দুর রকিব, মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ ও মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। সেই সময় এলাকায় কোনো হাই স্কুল ছিলনা। তাই তাঁর বড় ছেলে আব্দুর রকিবকে সুদূর মুর্শিদাবাদের মুসলিম হাই স্কুল থেকে পড়াশুনা করান। পরবর্তীতে তাঁর বড় ছেলে আব্দুর রকিব রাজশাহী ডিগ্রী কলেজ থাকে ডিগ্রী গ্রহণ সম্পন্ন করেন। কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার কলকাতাতে চাকুরী করেন এবং বঙ্গভঙ্গের পর পাকিস্থানে চলে আসেন। পাকিস্থান হওয়ার পর তিনি ডিসট্রিক্ট রেজিষ্ট্রার হিসেবে দীর্ঘ ৩০ বছর চাকুরী করে ১৯৭৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পুত্র আব্দুর রশিদ ডিগ্রি শেষ করে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে চাকুরী করেন। ছোট পুত্র আব্দুর রহিম ব্যবসায়ী ছিলেন।
তাঁর ভাতিজা ‘প্রফেসর আফসার উজ্জামান’ রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, গুণী শিক্ষাবিদ ও লেখক। এছাড়া তাঁর নাতী-নাতনীরা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চ শিক্ষিত। তাঁর সুযোগ্য পৌত্র কৃতী প্রকৌশলী ’আব্দুল মতিন’ বাংলাদেশ রোডস এ্যান্ড হাইওয়ে (সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর) এর চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁর আরেক সুযোগ্য পৌত্রী ‘হুসনুন নাহার নার্গিস’ একজন লেখক, গবেষক, নারী ও শিশু উন্নয়ন কর্মী। ‘হুসনুন নাহার নার্গিস’ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে (লন্ডন) নারী ও শিশু উন্নয়নে কাজ করছেন, অবদান রাখেছেন। অন্যান্য নাতী-নাতনীরা যথাক্রমে আজম মো. আব্দুল মাসুদ টি এ্যান্ড টি ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে কনসালটেন্ট, আলমগির আব্দুল মালেক, প্রিন্সিপ্যাল, বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী, জাহাঙ্গীর আব্দুর রাজ্জাক, বিসিক ম্যানেজার, শামসুন নাহার শিরীন, প্রফেসর অব ফিলোসফি, প্রফেসর নুরুন নাহার পারভীন, প্রিন্সিপ্যাল, রাজশাহী নিউ ডিগ্রী কলেজ, হুরুন নাহার বিলকিস এমএ অর্থনীতি, ফারুক আব্দুল মুনিম, ইনফরমেসান অফিসার। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী ‘মোহাম্মদ ইজারউদ্দীন পন্ডিত’ ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত/বিস্তারিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ www.alokito-chapainawabganj.com (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ১ম ও ২য় খণ্ড) লেখক- মাহবুবুল ইসলাম ইমন}