হাবিবুর রহমান (শেলি)

১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা/অন্তবর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রধান, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, মহান ভাষা আন্দোলের বীর সৈনিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, গবেষক ও লেখক- বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান (শেলি) ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা এ্যাড.জহিরউদ্দিন বিশ্বাস দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাতীয় যুক্তফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন৷ ১৯৪৭-দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে তাঁর পিতা স্বপরিবারে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷ হাবিবুর রহমানের পিতা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস বিয়ে করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরের মিসেস গুল হাবিবাকে। শুধু মাতুতালয়ই (নানার বাড়ি) নয়, বিচারপতি হাবিবুর রহমান নিজেও বিয়ে করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিববঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে। হাবিবুর রহমানের শৈশবের অনেকখানি কেটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের এই শ্যামপুরে (নানার বাড়ি)। পরবর্তীতে শ্যামপুর শ্বশুর বাড়ি হওয়ায় এখানে তিনি মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতেন। সর্বশেষ ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত ‘ঐতিহ্যবাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের’ সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত্ ছিলেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে বি.এ এবং ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে বি.এ ও স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, আইনজীবী, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, ভাষা সৈনিক, অভিধানপ্রণেতা। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে হাবিবুর রহমান তাঁর কর্মজীবন জীবন শুরু করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন (১৯৬১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে ঢাকা হাই কোর্ট বারে (সুপ্রিম কোর্ট) যোগ দেন। সহকারী এ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাই কোর্ট বার এ্যাসোসিয়শনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (১৯৭২), বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের (১৯৭২) সদস্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৬-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯৫ পর্যন্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯০-৯১ মেয়াদে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব¡ গ্রহণ করলে হাবিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন মুহম্মদ হাবিবুর রহমান।১৯৯৫ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে তিনি ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তথা অন্তবর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সাহিত্য ও অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন প্রখ্যাত গবেষক ও লেখক হাবিবুর রহমান। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক ৷ল’ অফ রিকুইজিশন (১৯৬৬), রবীন্দ্র প্রবন্ধে সঞ্জনা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮), যথা-শব্দ (১৯৭৪), মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩), কোরআন সূত্র (১৯৮৪), বচন ও প্রবচন (১৯৮৫), রবীন্দ্র কাব্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য (১৯৮৬), সরকার সংবিধান ও অধিকার (১৯৯৯), আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬), বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খন্ডবাক্য (১৯৯৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭), স্বাধীনতার দায়ভার (২০০৭) প্রভৃতি তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির একজন অন্যতম ফেলো ও লিঙ্কাস ইন এর বেঞ্চার ছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। স্পেশাল কনট্রিবিউশন টু হিউম্যন রাইটস পুরস্কার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৫), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গবেষণা পরিষদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৪)সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। {অসমাপ্ত…/বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষপ্তি জীবনী)}