শেখ সফিউর রহমান ওরফে সুফি মাস্টার

আধুনিক গম্ভীরা গানের প্রবর্তক-জনক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গম্ভীরা শিল্পী, কিংবদন্তি ‘ওস্তাদ শেখ সফিউর রহমান ওরফে সুফি মাস্টার’ ১৮৯৪ সালে তৎকালীন মালদহ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) জেলার ইংরেজ বাজার থানার ফুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফুলবাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেও দীর্ঘদিন (মৃত্যুঅবধি) চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের বাজার এলাকায় পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। তাঁর পিতার নাম শেখ বেশারত। ১৯০৭ সালে ডাক বিভাগে প্যাকারের চাকুরী দিয়ে শেখ সফিউর রহমানের কর্মজীবন শুরু হয়। খুলনায় পোস্ট মাষ্টার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৫১ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। চাকুরির পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা অব্যহত রাখেন। বাংলা লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে ‘গম্ভীরা গানের ওস্তাদ সুফি মাস্টার’ নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
প্রথিতযশা গম্ভীরা রচয়িতা `সুফি মাস্টার’ মূলত একজন ‘স্বভাব কবি’। প্রথম দিকে তিনি পালাগান, নিমাই সন্ন্যাস, রাধার মানরঞ্জন ইত্যাদি রচনা করেন। মালদহের খ্যাতিমান আলকাপ শিল্পী ‘সরকার আকবর খলিফার’ দলে তিনি কিছুদিন আলকাপ গানও করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘কিশোরী মোহন চৌধুরী ওরফে কিশোরী পন্ডিতের’ গম্ভীরা দলে যোগদান করেন। একসময় তিনি নিজেই একটি গম্ভীরা দল গঠন করেন। মালদহ থেকে ১৩২৯ বঙ্গাব্দে সুফি মাস্টার রচিত ‘গম্ভীরা সংগীত’ নামে একটি ‘গম্ভীরা সংকলন’ প্রকাশিত হয়। তাঁর বহুগান সেসময় গ্রামোফোনে রেকর্ড করা হয়েছিল। দেশ-বিভাগ পূর্বকালে তাঁর পালা গম্ভীরা গানের প্রতিটা চরিত্রই ছিল ব্রিটিশবিরোধী। এক সময়ে গম্ভীরা গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নজরবন্দি করে রাখে। সুফি মাস্টারের মাথার মূল্য এক হাজার টাকা ঘোষণা করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। সুফি মাস্টার রচিত বেশকিছু ‘লোকগীতি’ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সেই সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সুফি মাস্টার রচিত ‘সাহেব ধরি ও লাঙ্গল কলার গাছ হে, নাচাইছে বেশ ভালুক নাচহে’ প্রভৃতি বাংলা লোক-সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব, অমর সৃষ্টি…! চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব লোকসংস্কৃতি ‘আধুনিক গম্ভীরা’ গানের প্রবর্তক-সুফি মাস্টার পালা গম্ভীরাকে ‘নানা-নাতীর’ ভূমিকায় রুপ দিয়ে ডুয়েট আধুনিক গম্ভীরার রুপায়ন করেন। এই রুপায়ন প্রক্রিয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোলেমান মোক্তার, কালু মোক্তার ও পশুপতি মোক্তার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্য ভাষণ বা গুমর ফাঁক করাই গম্ভীরা গানের মূল উদ্দেশ্য। এ গানের একটা সংগ্রামী ঐতিহ্য আছে, যা সুফি মাস্টার থেকে আবহমানকাল ধরে বাঙালির জীবনে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী আরেকটি লোকসংস্কৃতি ‘আলকাপ’ গানের তিনি ভদ্র সংস্করণকারী।
গম্ভীরা, আলকাপসহ বিভিন্ন গান রচনার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরুপ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। ১৯১৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর কাছ থেকেও। শুধু গান রচনাই নয়, গম্ভীরার সুর, নাচের ছন্দভঙ্গিও শিষ্যদের শেখাতেন ওস্তাদ সুফি মাস্টার। ১৯৭৮ সালে রাজশাহী থেকে ‘মাদার বখ্শ সাহিত্য সংস্কৃতি পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে ‘উত্তরা সাহিত্য মজলিস পুরস্কার’ লাভ করেন প্রখ্যাত চারণ কবি ‘সুফি মাস্টার’। প্রায় ৯০ বছর বয়সে ১৯৮০ সালে আধুনিক গম্ভীরা গানের প্রবাদ পুরুষ ‘শেখ সফিউর রহমান সফি মাস্টার’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে মৃত্যুবরণ করেন। { অসমাপ্ত…/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী) }