জিয়াউল হক

সমাজসেবী, সাদামনের আলোকিত মানুষ- ‘জিয়াউল হক’ (দইওয়ালা) ১৯৩৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চামামুশরীভূজা গ্রামের এক অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। দারিদ্রতা আর অশিক্ষার মধ্যে বড় হওয়া জিয়াউল হক পেশায় একজন দই বিক্রেতা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়ে কোন রকমে সংসার চালালেও প্রতিদিন দুই-একটি বই কিনতে কিনতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন বিশাল এক পাঠাগার। গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশ আর পারিবারিক চরম দারিদ্রতার কারণে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। চরম দারিদ্রতার মধ্যে থেকেও তিনি এলাকার গরীব, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিয়ে সহযোগিতা করতেন। ১৯৫৯ সালে চামামুশরীভূজা ও পাশের গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঁচজন ছাত্রের হাতে পাঁচসেট বই তুলে দেন এবং সেখান থেকেই মূলত তাঁর মহৎ কর্মোদ্দমের শুভ সূচনা…। শুধু বই নয়- খাতা, কলম, পেন্সিল, চক, ব্যাগ প্রভৃতি শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের দিতে থাকেন। মাঝে মধ্যে আর্থিক সহযোগিতাও করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁর সংগ্রহে অনেকগুলো বই হয়ে গেলে ১৯৮০ সালে চামামুশরীভূজা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক পারিবারিক পাঠাগার’।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দৈনিক নবাব, রাজশাহীর দৈনিক দিনকাল, দৈনিক সোনালী সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশিত হলে তিনি দেশবাসী তথা সর্বসাধারণের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীকালে জিয়াউল হক তাঁর লাইব্রেরীর নাম পরিবর্তন করে ‘জিয়াউল হক ইসলামী পাঠাগার’ নামকরণ করেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরী সম্পর্কে উল্লেখিত দৈনিক ছাড়াও দৈনিক প্রধম আলোসহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশনে (ইটিভি) ‘জিয়াউল হক ইসলামী পাঠাগার’ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদেন প্রকাশ হলে দেশ-বিদেশে জিয়াউল হকের মহিমা ও গুণ কীর্তন ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল-১৫ মে , ইফনিলিভার বাংলাদেশ লি. এ্যাডকমের (বিজ্ঞাপনী সংস্থা) সহযোগিতায় দেশবাসীর কাছে ‘সাদা মনের মানুষ’-এর সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বাংলদেশ টেলিভিশনসহ সবগুলো টিভি চ্যানেল এবং প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তিন হাজার মনোনয়ন জমা পড়ে। দৈনিক পত্রিকার একটি সাংবাদিক দল প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে। সাংবাদিক দলটি দ্বিতীয় ধাপে ৫০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে এনটিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিবেদকের সরেজমিন পর্যবেক্ষণ শেষে এ্যাডকম ও ইফনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে। চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচক হিসেবে জাতীয় ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মতিউর রহমান, রোকেয়া আফজাল রহমান ও ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য-এর উপস্থিতিতে শীর্ষ দশ জন ‘সাদা মনের মানুষ’ নির্বাচন করেন। যার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের অজপাড়া-গাঁয়ের জিয়াউল হক (দই ওয়ালা) একজন হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ঢাকার হোটেল শেরাটনে গণ্যমান্য অতিথি, সামরিক, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিঝীবি, সাংবাদিক, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টাদের সরব উপস্থিতিতে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে নির্বাচিত দশ জনকে আনুষ্ঠানিক সম্মানা প্রদান করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রত্যেককে দু’ভরি ওজনের সোনার মডেল, মানপত্র, এবং দুই লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। জাতীয় পত্র-পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উক্ত সংবাদ, তথ্যচিত্র পরিবেশন এবং এনটিভি ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্মাননা অনুষ্ঠানের ধারণকৃত পুরো অনুষ্ঠানটি ২০০৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী সম্প্রচার করে।
জিয়াউল হকের জন্য ২০০৭ সাল ঘটনাবহুল একটি বছর। এইচএসবিসি থেকে অনুদান লাভের পর ইটালী, কানাডা থেকে ২ লক্ষ টাকা এবং নরওয়ে থেকে এক লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করে। সেই সময় লন্ডন প্রবাসী ডা.ফজলুর রহমান ২০০ পাউ- এবং ঢাকা ফ্রিডম ফাউন্ডেশন থেকে প্রায় ২ লক্ষ টাকা মূল্যের বই এবং ২৫ হাজার টাকা মূল্যের বুকসেল্ফ প্রদান করলে জিয়াউল হকের লাইব্রেরীটি আরও সমৃদ্ধ হয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় স্থানীয় পর্যায়ের অনুদান। এসব দান-অনুদানের প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে কিছু জমি কিনে পাঠাগারের জন্য একটা ঘর এবং নিজের বসবাসের জন্য একটি অতিরিক্ত ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। অনুদানের মোটা অংকের টাকা তিনি অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করেন। অনুদানের টাকায় বই-পত্র কেনার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আলমারী কিনেছেন। বর্তমানে এ লাইব্রেরীর বই সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এলাকার মানুষগুলোকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করছে তাঁর এই লাইব্রেরী। জিয়াউল হকের লাইব্রেরীতে প্রায় ৬শত সেট স্কুল-কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন স্কুল-কলেজের গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে প্রদান ও পাঠ শেষে ফেরৎ নেন। এভাবে ভোলাহাট উপজেলা ছাড়াও গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ, নাচোল, নবাবগঞ্জ সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা অর্জনের পথকে সুপ্রস্থ করে চলেছেন সমাজসেবী ‘দই ওয়ালা-জিয়াউল হক’।
শিক্ষা হিতৈষী ও সমাজসেবী এই ব্যক্তিকে এনটিভি ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্মাননা-২০০৭ ছাড়াও ১৯৯৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন, ১৯৯৩ সালে রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজ,২০০৩ সালে ভোলাহাট ছাত্র কল্যাণ সংস্থা, ১৯৯৯ সালে গোমস্তাপুর বইমেলা কর্তৃপক্ষ, ২০১০ সালে ঢাকাস্থ চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা সমিতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান-সংস্থা থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
দই বিক্রি, লাইব্রেরী দেখভাল ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি বর্তমানে জিয়াউল হক ভোলাহাটের জামেয়া আরাবিয়া ইসলামীয়া মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যেই ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ হয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত ‘সাদা মনের আলোকিত মানুষ’ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক-দইওয়ালা । {অসমাপ্ত…/ বিস্তারিত প্রকাশিতব্য মূল গ্রন্থ- ‘আলোকিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ (চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু’শো বছর ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষপ্তি জীবনী)}